2
3 হাজার চুরাশির মা
4 মহাশ্বেতা দেবী
5
6
7 সকাল
8 স্বপ্নে সুজাতা বাইশ বছর আগেকার এক সকালে ফিরে গিয়েছিলেন, প্রায়ই যাননিজেই ব্যাগে গুছিয়ে রাখেন তোয়ালে, জামা, শাড়ি, টুথব্রাশ, সাবানসুজাতার বয়স এখন তিপান্নস্বপ্নে তিনি দেখেন একত্রিশ বছরের সুজাতাকে, ব্যাগ গোছানোয় ব্যস্তগর্ভের ভারে মন্থর শরীর, তখনো যুবতী এক সুজাতা ব্রতীকে পৃথিবীতে আনবেন বলে একটি একটি করে জিনিস ব্যাগে তোলেনসেই সুজাতার মুখ বার বার যন্ত্রণায় কুঁচকে যায়, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না সামলে নেন সুজাতা, স্বপ্নের সুজাতা, ব্রতী আসছে
9 সেদিন রাত আটটা থেকেই যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, হেম অভিজ্ঞের মত বলেছিল, পেট নাবুতে নেমেছে মাআর দেরি নেইহেমই ওঁর হাত ধরে বলেছিল, ভাল ভালতে দুজনেই দুঠাঁই হয়ে ফিরে এস
10 যন্ত্রণা হচ্ছিল, ভয়ানক যন্ত্রণাযে কোন সময়ে সন্তান হতে পারে বলে সুজাতা আগের দিন থেকেই নার্সিংহোমেজ্যোতির বয়স তখন দশ, নীপার আট, তুলির ছয়শাশুড়ি সুজাতার কাছেই ছিলেন, মনে আছেজ্যোতির বাবা শাশুড়ির একমাত্র সন্তানএকটি সন্তান হতেই শাশুড়ি বিধবাসুজাতার সন্তান হওয়া দেখতে পারতেন না তিনি, ভয়ংকর বিদ্বেষের চোখে তাকাতেনঠিক সন্তান হবার সম-সমকালে চলে যেতেন বোনের বাড়ী, সুজাতাকে অকূলে ভাসিয়ে
11 স্বামী বলতেন মা অত্যন্ত নরম, বুঝলে? তিনি এসব দেখতে পারেন না, যন্ত্রণা-টন্ত্রণাচেঁচামেচি
12 অথচ সুজাতা চেঁচাতেন না, কাতরাতেন না কখনোদাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে ছেলেমেয়েদের বিলিব্যবস্থা করতেনসেবার শাশুড়ি এখানে ছিলেন, কেননা বোন কলকাতায় ছিলেন নাজ্যোতিদের বাবা কানপুর গিয়েছিলেন কাজে, মনে আছেদিব্যনাথ জানতেনও না মা থেকে যাবেন এবারথাকেন না, এবার
13
14
15 থাকবেন না এই জানতেনতবু সুজাতার জন্য ব্যবস্থা করে যান নি দিব্যনাথকোনদিনই করেন নিসুজাতা বাথরুমে গিয়ে যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠেনভয় পেয়ে যান রক্ত দেখেনিজেই সব গুছিয়ে নেন, ঠাকুরকে বলেন ট্যাক্সি আনতে
16 নার্সিংহোম চলে যান একা একাডাক্তার খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেনভয় পেয়েছিলেন খুবসুজাতার চোখ যন্ত্রণায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, যেন চোখের ওপর কাচ ঢেকে দিচ্ছিল কে, অস্বচ্ছ কাচজোর করে চোখ খুলে ডাক্তারের দিকে চেয়ে সুজাতা বলেছিলেন, অ্যাম আই অলরাইট?
17 নিশ্চয়
18 চাইল্ড?
19 আপনি ঘুমোন
20 কি করবেন?
21 অপারেশন
22 ডাক্তারবাবু1, চাইল্ড?
23 আপনি ঘুমোনআমি আছিএকা এলেন কেন?
24 উনি নেই
25 সুজাতা অবাক হয়েছিলেনতিনি আশাই করেন নি, কলকাতায় থাকলেও দিব্যনাথ সঙ্গে আসবেন, ডাক্তার কেন আশা করেনদিব্যনাথ সঙ্গে আসেন না সুজাতাকে নিয়ে যান না সময় হলেনবজাতকের কান্না শুনতে হবে বলে তেতলায় ঘুমোনসন্তানদের অসুখ হলেও রাতে খোঁজ নেন নাতবে দিব্যনাথ লক্ষ্য করেন, সুজাতাকে লক্ষ্য করে দেখেন, আবার মা হবার যোগ্য শরীর হচ্ছে কিনা সুজাতার
26 টনিক খাচ্ছ ?
27 গাঢ়, যেন কফবসা গলায় জিগ্যেস করেন দিব্যনাথকামনায় অস্থির হলে ওঁর গলায় যেন কফ জমে থকথকে হয়ে যায় স্বরসুজাতা জানেন দিব্যনাথকেদিব্যনাথ তাঁর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবার একটি অর্থই হতে পারেডাক্তার কি করে জানবেন দিব্যনাথকে?
28
29
30 সুজাতাকে ওষুধে দেনওষুধে ব্যথা কমে নিসেই সময়ে সহসা সুজাতার মনে ভীষণ ব্যাকুলতা এসেছিল সন্তানের জন্যেতুলি হবার পর বছর কেটে যায় প্রায়অনেক কষ্টে সুজাতা নিজেকে রক্ষা করেছিলেন, শেষ রাখতে পারেন নি
31 তাই অশ্লীল, অশুচি লেগেছিল নিজেকে মাস ধরেশরীরের ক্রমবর্ধমান ভারকে মনে হয়েছিল অভিশাপকিন্তু যখন বুঝলেন তাঁর আর সন্তানের জীবনসংশয় হতে পারে, তখনি বুক ভরে উঠেছিল ব্যাকুল মমতায়সুজাতা ডাক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেনবলেছিলেন, অপারেশন করুন ওকে বাঁচান
32 তাই করছি
33 ডাক্তারের কথায় নার্স ইঞ্জেকশন দেয়যন্ত্রণা সুজাতার তলপেট ফুঁড়ে ফুঁড়ে ঢুকছিল আর বেরোচ্ছিলউনিশশো আটচল্লিশ সালষোলই জানুআরিসুজাতা বিছানার সাদা চাদর খামচে ধরছিলেন বার বারকপাল ঘেমে উঠছিলচোখের নিচে কালো দাগটা ছড়িয়ে পড়ছিল, বড় হচ্ছিলএকটুও শীত করছিল না সুজাতারঅথচ সে জানুআরিতে তীব্র শীত
34
35 তলপেটে যন্ত্রণা ফুঁড়ে ফুঁড়ে ঢুকছে আর বেরোচ্ছেবিছানার সাদা চাদর খামচেঘামতে ঘামতে সুজাতা জেগে উঠলেনপাশে জ্যোতির বাবাকে দেখে তাঁর সাদা কপালে লম্বা ভুরু দুটো কুঁচকে গেলজ্যোতির বাবা পাশের খাটে কেন? তারপর মাথা নাড়লেন! ব্রতী হবার দিন জ্যোতির বাবা কাছে ছিলেন না, তাই সুজাতার স্বপ্নেও দিব্যনাথ কখনো থাকেন না, কিন্তু এখন আর স্বপ্ন দেখছেন না সুজাতা
36 তারপর কোনমতে হাত বাড়ালেনব্যারালগান1 ট্যাবলেটজলট্যাবলেট খেলেন, জল খেলেনআঁচল দিয়ে কপাল মুছলেন
1Baralgan is a painkiller
37 আবার শুলেনএখন খুব দরকার এক থেকে একশো গুণে ফেলাডাক্তারের নির্দেশগুণলেই ব্যথা কমে যায়গুণতে যা সময় লাগে, তার মধ্যেই ব্যারালগান কাজ করতে শুরু করেব্যথা কমে
38
39
40 তারপর ব্যথা কমেসুজাতাকে ক্লান্ত, অবসন্ন, পরাজিত করে ব্যথা কমেব্যথা এখনই কমেছেএখন ব্যথা কমা দরকারঘড়ির দিকে চাইলেনটা বেজেছেদেওয়ালের দিকে চাইলেনক্যালেণ্ডারসতেরই জানুআরিষোলই জানুআরি সারারাত যন্ত্রণা ছিল, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, ইথারের গন্ধ, চড়া আলো, আচ্ছন্ন যন্ত্রণার ঘোলাটে পর্দার ওপারে ডাক্তারদের নড়াচড়া সারারাত, সারারাত, তারপর ভোরবেলা, সতেরই জানুআরি ভোরে ব্রতী এসে পৌঁছেছিলআজ সেই সতেরই জানুআরি, সেই ভোর, দুবছর আগে সতেরই জানুআরি এই ঘরে, এমনি করে এই লোকটির পাশের খাটেই ঘুমোচ্ছিলেন সুজাতাটেলিফোন বেজেছিলপাশের টেবিলহঠাৎ
41 টেলিফোন বাজছেজ্যোতির ঘরেদুবছর আগে সেদিনের পরেই জ্যোতি টেলিফোনটা ওর নিজের ঘরে নিয়ে যায়, বিবেচক, বিবেচক জ্যোতিতাঁর প্রথম সন্তান, তাঁর জ্যেষ্ঠদিব্যনাথের অনুগত বাধ্য ছেলেবিনির সহৃদয় স্বামী, সুমনের স্নেহময় পিতা
42 বিবেচক জ্যোতিসুজাতা দুবছর আগে একান্ন পার করেছিলেন, জ্যোতির বাবা ছাপান্ননিরাপদ বয়স, জীবন দুজনের গুছানো সুশৃঙ্খলমেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছোট মেয়ে মন পাত্র স্থির করেছে, বড়ছেলে সুপ্রতিষ্ঠিত, ছোট ছেলেকে বাবা কলেজের পরই বিলাতে পাঠাবেনসব গুছানো, সুশৃঙ্খল, সুন্দর ছিল, বড় সুন্দর
43 সেই সময়ে সেই বয়সে টেলিফোন বেজেছিলমা ঘুমচোখে1 রিসিভার তুলেছিলেনহঠাৎ একটা অচেনা নৈর্ব্যক্তিক অফিসার কণ্ঠ জিগ্যেস করেছিল, ব্রতী চ্যাটার্জি আপনার কে হয়?
44 ছেলে? কাঁটাপুকুরে আসুন
45 হ্যাঁ, সেই মুখ-অবয়ব-রক্তমাংসহীন1 কণ্ঠ বলেছিল, কাঁটাপুকুরে আসুনরিসিভার আছড়ে পড়েছিলমা পড়ে গিয়েছিল দাঁতে দাঁত লেগে
46 দুবছর আগে সতেরই জানুআরির ভোরে ব্রতীর জন্মদিনে, ব্রতীর পৃথিবীতে পৌঁছবার সম-সমকালে এই সুন্দর ঝকঝকে বাড়িতে, এই শান্ত সুন্দর পরিবারে,
47
48
49 এই টেলিফোনের খবরের মত একটা বিশৃঙ্খল, হিসেব ছাড়া ঘটনা ঘটেছিল
50 সেই জন্যেই জ্যোতি টেলিফোনটা সরিয়ে নিয়ে যায়সুজাতা তা জানতেন নাতিনমাস সুজাতা কিছুই জানতেন নাবিছানায় পড়ে থাকতেন চোখে হাতচাপা1 দিয়েকখনো কাঁদতেন না চেঁচিয়েহেম, একা হেম ওঁর কাছে থাকত, ঘুমের ওষুধ দিত, ওঁর হাত ধরে বসে থাকত
51 তাই সুজাতা জানতেন না কবে টেলিফোনটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়
52 তিনমাস বাদে সুজাতা আবার ব্যাঙ্কে যেতে শুরু করলেনআবার জ্যোতি নীপা আর তুলির সঙ্গে সহজভাবে কথা বললেনজ্যোতির ছেলে সুমনের পেন্সিল কেটে দিলেনজ্যোতির স্ত্রী বিনিকে বললেন, আমার কালোপাড়1 শাড়ীটা কি কাচতে দিয়েছ?
53 জ্যোতির বাবা যখন বম্বে গেলেন, তখন তাঁর সুটকেসে ইসবগুলের ভুসি দিয়ে দিলেন
54 এমনি করেই কখন স্বাভাবিক হয়ে গেল সব, সহজ হয়ে গেল, তখন সুজাতা লক্ষ্য করলেন টেলিফোনটা তাঁর ঘর থেকে জ্যোতির ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
55 দেখেই ওঁর ভুরু কুঁচকে গিয়েছিলজ্যোতির বুদ্ধি এত কম! মাথা নেড়েছিলেন বার বার জ্যোতির নির্বোধিতা দেখেএখন আর কোন টেলিফোন আসবে নাজ্যোতির বাবার নিজস্ব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির আপিসজ্যোতি ব্রিটিশ নামাঙ্কিত ফার্মে মেজসাহেবনীপা, বড় মেয়ের বর কাস্টম্সে বড় অফিসারতুলি যাকে বিয়ে করেছে, সেই টোনি কাপাডিয়া নিজে এজেন্সি খুলে সুইডেনে ভারতীয় সিল্ক-বাটিক, কার্পেট, পেতলের নটরাজ বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া পাঠায়জ্যোতির শ্বশুর-শাশুড়ি বিলাতেই থাকেন
56 এরা কেউ এমন কোন বেহিসেবী, বিপজ্জনক কাজ করবে না যেজন্যে হঠাৎ টেলিফোন আসতে পারে, হঠাৎ কাঁটাপুকুর মর্গে ছুটে যেতে হবে সুজাতাকে
57 এরা কেউ এমন বিরোধিতা করবে না, যেজন্যে জ্যোতি আর তার বাবাকে
58
59 ১০
60 ছুটোছুটি করতে হয় ওপর মহলে1, কাঁটাপুকুরে যেতে হয় শুধু সুজাতা আর তুলিকে
1ওপর মহল = the corridors of power
61 এরা কেউ এমন অপরাধ করবে না যেজন্যে কাঁটাপুকুরে পড়ে থাকতে হয় চিত হয়েএকটা ভারি চাদর সরিয়ে ধরে ডোম. সি. জিজ্ঞেস করে, "ডু ইউ আইডেনটিফাই ইওর সান?"
62 এরা সবাই বিবেচক, নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে, সৎ নাগরিকএরা সুজাতাকে তেমন কোন অবস্থায় ফেলবে না, জ্যোতির বাবাকে বাধ্য করবে না ছুটোছুটি করতেসত্যি বলতে কি, তাঁর ছেলে এমন কলঙ্কিতভাবে মরেছে, এই খবরটা ঢাকবার জন্যে জ্যোতির বাবা দড়ি টানাটানি করে বেড়াচ্ছিলেন
63 টেলিফোন খবরটা জানবার পরই জ্যোতির বাবার প্রথমেই মনে হয়েছিল কেমন করে খবরটা চেপে যাবেনমনে হয় নি কাঁটাপুকুরে তাঁর যাওয়াটা বেশি জরুরীজ্যোতি তাঁরই ভাবাদর্শে গড়া, সেও বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল
64 সুজাতাকে বাড়ির গাড়ি অব্দি নিতে দেননি দিব্যনাথকাঁটাপুকুরে তাঁর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে, সে কি হয়? যদি কেউ দেখে ফেলে?
65 সেদিন ব্রতীর সঙ্গে সঙ্গে সুজাতার চেতনায় ব্রতীর বাবারও মৃত্যু ঘটেব্রতীর বাবার সেদিনের, সেই মুহূর্তের ব্যবহার সুজাতার চেতনায় প্রবল উল্কাপাত ঘটায়বিরাট বিস্ফোরণআদিম পৃথিবীতে যেমন ঘটেছিল কোটি কোটি বছর আগেযেমন বিস্ফোরণে মহাদেশগুলো ছিটকে ম্যাপের দুপাশে সরে গিয়েছিলমাঝখানের দুস্তর ব্যবধান ঢেকে ফেলেছিল মহাসমুদ্র
66 দিব্যনাথের সেদিনের ব্যবহারের ফলে, দিব্যনাথ জানেন না, সুজাতার চেতনায় তিনি মরে গেছেন, অবশেষে সরে গেলেন বহুদূরেসুজাতার পাশেই শুয়ে থাকেন দিব্যনাথ, কিন্তু জানতে পারেন না, মৃত ব্রতীর চেয়ে জীবিত দিব্যনাথের মানসম্মানের কথা, নিরাপত্তার কথা বেশি ভেবেছিলেন সেদিন, তাই সুজাতার কাছে তিনি অনস্তিত্ব হয়ে গেছেন
67 দিব্যনাথের ছোটাছুটি দড়ি টানাটানি সফল হয়েছিলপরদিন খবরের
68
69 ১১
70 কাগজে চারটি ছেলের হত্যার খবর বেরোয়নাম বেরোয়ব্রতীর নাম কোন কাগজে ছিল না
71 এইভাবে ব্রতীকে মুছে দিয়েছিলেন দিব্যনাথকিন্তু সুজাতা তা পারেন না
72 সেরকম নিয়ম-ছাড়া, রুটিন-ছাড়া ঘটনা বাড়িতে আর ঘটবে নাতবু জ্যোতি টেলিফোন সরিয়ে নিয়ে গেছে দেখে সুজাতা কৌতুকবোধ1 করেছিলেন
73 বিনি ওঁর ঠোঁটে কৌতুকের হাসি দেখে মনে এত আঘাত পায় যে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেজ্যোতিকে বলে, শী হ্যাজ নো হার্ট
74 কথাটা সুজাতাকে শুনিয়ে বলাসুজাতা শুনেছিলেন, ক্ষুণ্ণ হন নিওঁর আগে মনে হয়েছে, আবার মনে হয়েছে, আবার মনে হয়েছিলবিনি ব্রতীকে ভালবাসত
75 তখন মনে হয়েছিল বিনি ব্রতীকে ভালবাসেপরে সে কথা মনে হয় নিকেননা বারান্দায় ব্রতীর ছবিটা খুঁজে পান নি সুজাতা, ব্রতীর জুতোগুলো দেখতে পান নিব্রতীর বর্ষাতিও ছিল না
76 বিনি, ছবিটা কোথায় গেল?
77 তেতলার ঘরে
78 তেতলার ঘরে?
79 বাবা বললেন...
80 বাবা বললেন!
81 ব্রতী চলে যাবার পরও ব্রতীকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রয়াস দিব্যনাথ ছাড়েন নি দেখে সুজাতা অবাক হন নি, দুঃখও পান নি নতুন করেশুধু অবসন্ন মনে ভেবেছিলেন, দিব্যনাথই বলতে পারেন এমন কথাকিন্তু বিনি কি, না! বলে বাধা দিতে পারত না?
82 কোন কথা না বলে সুজাতা ব্যাঙ্কে চলে যানব্যাঙ্কে চাকরি তাঁর বহুদিনেরব্রতীর তিনবছর বয়সে তিনি কাজে ঢোকেনব্রতীর বাবার আপিসে তখন একটু টালমাটাল যাচ্ছিলদুটো বড় বড় অ্যাকাউণ্ট বেরিয়ে গিয়েছিল হাত থেকে
83
84 ১২
85 সেই সময়ে কাজে ঢোকেন সুজাতাপরিবারের সবাই তাঁকে খুব উৎসাহ দিয়েছিলএমন কি শাশুড়িও বলেছিলেন, করাই উচিততুমি বলেই এতদিন বাড়িতে বসেছিলেদিবুও তেমন নয়তেমন হলে তোমাকে আগেই কাজ করতে পাঠাত
86 সুজাতা কেন চাকরি করতে চাইছেন, কেন নিজে খোঁজ করে যোগাযোগ করছেন, সে-কথা কেউ জানতে চাইবার যোগ্য, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নিসেটা ভালই হয়েছিল বাড়িতে দিব্যনাথ আর তাঁর মা সকলের মনোযোগ সবসময়ে আকর্ষণ করে রাখতেনসুজাতার অস্তিত্বটা হয়ে গিয়েছিল ছায়ার মতঅনুগত, অনুগামী, নীরব, অস্তিত্বহীন
87 চেনাশোনা লোক ছিলেন ব্যাঙ্কেনইলে কাজটা হত নাসুজাতা চাকরি পেয়েছিলেন পরিবার, বংশপরিচয়, অভিজাত চেহারা, বিশুদ্ধ ইংরাজী উচ্চারণের জোরেনইলে তাঁর মত লোরেটোর বি. . পাস মহিলা কতই আছেন, তা কি সুজাতা জানতেন না?
88 শুধু ব্রতী কাঁদত
89 স্বপ্নে, তাঁর স্বপ্নে, তিন বছরের ব্রতী তাঁর হাঁটু জড়িয়ে ধরে কতবার কেঁদে বলে, মা তুমি আজ, শুধু আজ আপিসে যেও না, আমার কাছে থাক
90 ফর্সা, রোগা ব্রতী, রেশম রেশম চুল, চোখে মমতা
91 সেই ব্রতীমুক্তির দশকে একহাজার তিরাশিজনের মৃত্যুর পরে চুরাশি নম্বরে ওর নামকেউ যদি মুক্তির দশকের আড়াই বছরে নিহত ছেলেদের নাম সংগ্রহ করে থাকে, তবে সে কি ব্রতীর নাম খুঁজে পাবে? কাগজ দেখে যদি খোঁজ করে থাকে, সে জানবে না ব্রতীকে
92 ব্রতীর বাবা ওর নাম কাগজে উঠতে দেন নি
93 ব্রতী চ্যাটার্জি?
94 আপনি কে হন?
95 না, মুখ দেখতে হবে না
96 আইডেণ্টিফিকেশন মার্ক?
97
98 ১৩
99 গলায় জড়ুল?
100 মুখ দেখতে হবে না?
101 কি বলেছিলেন তিনি? আমি দেখব? নীল শার্ট দেখে, আঙুল দেখে, চুল দেখে, কোথায় তবু সংশয় ছিল মনেকোথায় যুক্তি বুদ্ধি চোখের দেখা সব পরাস্ত করে সংশয় বলছিল, না মুখ দেখলে জানা যাবে ব্রতী নয়? তাই কি সুজাতা বলেছিলেন....
102 ডোমটি ওঁর ওপর অসীম করুণায় বলেছিল, কি আর দেখবেন মাইজী1? মুখ কি আর আছে কিছু?
1a respectful term of address for a woman in Hindi
103 তখন কি করেছিলেন সুজাতা? অন্য চারটি শব পড়ে আছেকারা যেন আকুল হয়ে কাঁদছেকে যেন মাথা ঠুকছে মাটিতেকারো মুখ মনে পড়ে নাসব ধোঁয়া ধোঁয়াকিন্তু কোন কোন স্মৃতি হীরের ছুরির মত উজ্জ্বল, কঠিন, স্বয়ংপ্রভ
104 ওর বুকে, পেটে আর গলায় তিনটে গুলির দাগ ছিলনীল গর্তশরীরে খুব কাছ থেকে ছোঁড়া গুলিনীলচে চামড়াকর্ডাইটের1 ঝলসানিতে পোড়া বাদামী রক্তগর্তের চারদিকে কর্ডাইটের ঝলসানিতে ঝলসানো হেলো2, চক্রাকার ফাটাফাটা চামড়াগলায়, পেটে আর বুকে তিনটে গুলির দাগ
1Cordite is like gunpowder
2halo
105 ব্রতীর মুখ, ব্রতীর মুখ, সুজাতা সবলে দুহাতে চাদর সরিয়ে দেন, ব্রতীর মুখশাণিত ভারি অস্ত্রের উলটো পিট দিয়ে ঘা মেরে থেঁতলানো, পিষ্ট, ব্রতীর মুখপেছন থেকে তুলির অস্ফুট আর্তনাদ
106 সেই মুখই দেখেন সুজাতা ঝুঁকে পড়েআঙুল বোলালেনব্রতী! ব্রতী! বলে আঙুল বোলালেন, আঙুল বোলাবার মত মসৃণ চামড়া ছিল না এক ইঞ্চিওসবই দলিত, থেঁতলানো মাংসতারপর সুজাতাই মুখ ঢেকে দেনপেছন ফেরেনঅন্ধের মত তুলিকে জাপটে ধরেন
107 ব্রতীর বাবা ছবিটা সরিয়ে দিতে বলেছেন, একথা ব্যাঙ্কে যাবার সময়ও মনে ছিলপ্রথম দিন ব্যাঙ্কে যাবার সময়ে
108
109 ১৪
110 ব্যাঙ্কে সবাই ওঁর দিকে তাকাচ্ছিলহঠাৎ সকলের কথা আস্তে হয়ে গিয়েছিল, তারপর চুপচাপ
111 এজেণ্ট লুথরা এগিয়ে এসেছিল
112 ম্যাডাম, সো সরি...
113 থ্যাংক য়ুসুজাতা মুখ তোলেন নি
114 মেমসাব!
115 একটা জলের গেলাসভিখন এগিয়ে ধরেছিলসুজাতার পুরনো অভ্যেস, আপিসে এসে জল খান এক গেলাস
116 মেমসাব!
117 ভিখন আস্তে বলেছিলসুজাতা ওর চোখে বেদনা দেখেছিলেন, মমতাভিখন চোখ দিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরেছেউনি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলেন একদিনযেদিন ব্যাঙ্কে তার এসেছিল ভিখনের ছেলে অসুখে মরে গেছে
118 ভিখনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন সুজাতাএখনি উনি ওর সহানুভূতি নিতে পারছেন নাভিখন, আমায় ক্ষমা করব্রতীর মৃত্যু তোর ছেলের মৃত্যুর মত নয় যে? তোর ছেলের মৃত্যু এমন মৃত্যু, তাতে তোকে দেখলেই তুই যে বেয়ারা তা ভুলে গিয়ে তোকে জড়িয়ে ধরা যায়
119 ব্রতী তো তেমন করে মরে নিব্রতীর মৃত্যুর আগে অনেক প্রশ্ন পরে অনেক প্রশ্নপ্রশ্নচিহ্নসরাসরি প্রশ্নচিহ্নের মিছিলতারপর সব প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকতেই, একটি প্রশ্নেরও উত্তর না মিলতেই হঠাৎ ব্রতী চ্যাটার্জির ফাইল বন্ধ করে দেওয়া
120 তুই আমাকে মাপ কর ভিখন
121 সারাদিন যন্ত্রচালিতের মত কাজ করছিলেনসন্ধ্যায় ব্রতীর বাবা বাড়ী ফিরতেই জিগ্যেস করেছিলেন,
122 তুমি ব্রতীর ছবি তেতলায় সরিয়ে দিতে বলেছ?
123 হ্যাঁ
124 ব্রতীর জুতো?
125
126 ১৫
127 হ্যাঁ
128 কেন?
129 কেন!
130 দিব্যনাথ নেড়েছিলেনকেন ব্রতীর জিনিসপত্র সরিয়ে দেওয়া দরকার, কেন ব্রতীর অস্তিত্ব, স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা দরকার তা যদি সুজাতা না বোঝেন, কে তাঁকে বোঝাবে?
131 দিব্যনাথ কথা বলেন নি
132 তেতলার ঘর কি চাবি বন্ধ?
133 হ্যাঁ
134 চাবি কার কাছে?
135 আমার কাছে
136 দাও
137 চাবিটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন সুজাতাতেতলার ঘরে ব্রতী ঘুমোতআট বছর থেকে ওই ব্যবস্থাপ্রথমটা একা শুতে চাইত নাএকলা শুতে ওর ভয় করতসুজাতা বলেছিলেন, ঠিক আছে, হেম মেঝেতে শোবে
138 দিব্যনাথ রেগে যানজ্যোতির বেলা সুজাতার এই দুর্বলতা ছিল না, নীপা আর তুলির বেলাতেও নয়, এইসব কথা বলেনসুজাতা বলেছিলেন, ওদের বেলাতে ওঁর আপত্তি ছিলকেন না ওরাও ভয় পেত, কিন্তু তখন দিব্যনাথ যা বলেছেন তার অন্যথা হতে পারে সুজাতা জানতেন না
139 ভয় পেত ব্রতী, খুব ভয় পেতঅত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ শিশু যেমন ভয় পায়রাতে হরিধ্বনি শুনে ভয় পেত, দিনে বহুরূপী ডাকাত সেজে এসে চেঁচালে ভয় পেততারপর একদিন ওর সব ভয় চলে যায়
140 এখন তো ব্রতী সব ভয় আর অভয়ের বাইরে
141 ছোটবেলা থেকে মৃত্যুর কবিতা বড় প্রিয় ব্রতীরতাইত সুজাতার স্বপ্নে সাতবছরের ব্রতী পা ঝুলিয়ে জানলায় বসে বসে কবিতা পড়ে কতস্বপ্নে
142
143 ১৬
144 সুজাতা যখন ব্রতীকে দেখেন, তখন তাঁর মনে দুরকম চেতনা কাজ করতে থাকেএকটা মন বলে স্বপ্নব্রতী নেই শুধু স্বপ্ন
145 আরেকটা মন বলে স্বপ্ন নয় সত্যি
146 সুজাতার স্বপ্নে তাই ব্রতী জানলায় বসে পা ঝুলিয়ে কবিতা পড়েসুজাতা বিছানায় বসে শোনেন, ব্রতীর বিছানায়শোনেন আর ব্রতীর চাদর টেনে দেনবালিশ ঠিক করে দেন
147 কখনো ব্রতী ঘুমিয়ে পড়ে,
148 "ভয়কাতুরে ছিল সে সবচেয়ে
149 সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।"
150 কখনো বা স্বপ্নে দেখেন ব্রতীশিশুবইটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে পড়ছে
151 আঁধার রাতে চলে গেলি তুই
152 আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়
153 কেউতো1 তোরে2 দেখতে পাবে না
154 তারা শুধু তারার পানে চায়।’
155 ঘুমের মধ্যেব্রতী!’ বলে ডুকরে ডেকে ওঠেন সুজাতাতারপর ঘুম ভেঙে যায়এত সত্যি যে স্বপ্নে, এত সত্যি যে, চমকে চমকে চেয়ে সুজাতা দেখেন ব্রতী কোথায়!
156 তেতলার ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সুজাতাব্রতীর বিছানা গোটানোজামা আলমারিতে তোলাদেওয়ালে ছবিশেল্ফে বইশুধু স্যুটকেসটা নেইওটা পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল
157 ব্রতীর খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে সুজাতা ভুরু কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করছিলেন, ব্রতীর হত্যার পেছনে তাঁর কি পরোক্ষ অবদান ছিল? কিভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন ব্রতীকে যেজন্যে এই দশকে, যে দশক মুক্তির দশকে পরিণত হতে চলেছে সেই দশকে, ব্রতী হাজার চুরাশি হয়ে গেল! অথবা কি করতেন তিনি, অথচ করেন নি বলে ব্রতী হাজার চুরাশি হয়ে গেল? কোথায় সুজাতা ব্যর্থ হয়েছিলেন?
158
159 ১৭
160 দিব্যনাথ ব্রতীকে সহ্য করতে পারতেন নাবলতেন,
161 মাদার্স চাইল্ড! তুমি ওকেই শিখিয়েছ আমার শত্রু হতে
162 সুজাতা অবাক হয়ে যেতেনকেন তিনি ব্রতীকে বলতে যাবেন তোর বাবার শত্রু ’? কেন বলবেন? দিব্যনাথ কি সুজাতার শত্রু? দিব্যনাথ যাতে যাতে বিশ্বাস করেন, সেই সম্ভ্রান্ততায়, সচ্ছলতায়, নিরাপত্তায় সুজাতাও বিশ্বাস করেনবিশ্বাস করেন কিনা সুজাতা কখনো সে প্রশ্ন নিজেকে করেন নিকরেন নি যখন, তখন নিশ্চয় তাঁর কোন প্রশ্নই ছিল না
163 সুজাতা বড়ঘরের মেয়েঅত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবার তাঁদেরলোরেটোয় পড়ানো বি. . পাস করানো সবই বিয়ের জন্যেছেলের অবস্থা খারাপ, জেনেশুনেই তাঁকে বড়ঘরের ছেলে দিব্যনাথের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়সুজাতার বাবা জানতেন দিব্যনাথ অনেক ওপরে যাবেন
164 এই বাড়ি, সচ্ছলতা, নিরাপত্তা, এতে সুজাতাও বিশ্বাস করেনঅতএব দিব্যনাথের অভিযোগ মিথ্যে
165 যদি দিব্যনাথের অভিযোগ মিথ্যে হয়, তাহলে শুধু এই প্রমাণ হয় যে, সুজাতা ব্রতীকে দিব্যনাথের শত্রু হতে বলেন নি প্রমাণ হয় না যে ব্রতী ওর বাবাকে শত্রু ভাবেব্রতী যে দিব্যনাথকে সহ্য করতে পারে না সে সুজাতাও জানেনভাল করেই জানেন
166 কেন, ব্রতী?
167 দিব্যনাথ চ্যাটার্জি একক ব্যক্তি হিসেবে আমার শত্রু নন
168 তবে?
169 উনি যে সব বস্তু মূল্যে বিশ্বাস করেন, সেগুলোতেও অন্য বহুজনও বিশ্বাস করেএই মূল্যবোধ যারা লালন করছেন, সেই শ্রেণীটাই আমার শত্রুউনি সেই শ্রেণীরই একজন
170 কি বলিস তুই ব্রতী? বুঝি না
171 বুঝতে চেষ্টা করছ কেন? বোতামটা লাগাও না
172 ব্রতী, তুই খুব অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিস
173
174 ১৮
175 কি রকম?
176 বদলে যাচ্ছিস
177 বদলাব না?
178 কোথায় ঘুরিস সারাদিন?
179 আড্ডা দিই
180 কাদের সঙ্গে?
181 বন্ধুদের
182 নে তোর জামাবোতাম লাগাতে বললি তাই মার দুটো কথা বলার সময় হল
183 ব্রতী কথা বলে নিচোখ কুঁচকে হেসেছিলওর হাসিতে কথা বলার ভঙ্গিতে কি যেন এসে যাচ্ছিল ক্রমাগতসহিষ্ণুতা, ধৈর্যযেন সুজাতা কথা বলার আগেভাগেই জানে ওর কথা সুজাতা বুঝবেন নাওঁর সঙ্গে কথা বলত যেন ওর বাবা, সুজাতা ওর ছোট মেয়েওঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেলে ভোলাচ্ছে ব্রতীসুজাতা বুঝতে পারছিলেন ব্রতী ওঁর অজানা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে, অচেনাতখন মনে দুঃখ হয়েছে খুবকেন মনে আশঙ্কা হয় নি? ভয় হয় নি?
184 কেন মনে হয় নি মার কাছে ছেলে ক্রমেই অচেনা হয়ে যায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এক বাড়িতে বাস করেও, থেকে ভীষণ বিপদ হতে পারে একদিন?
185 ব্রতীর ঘরে দাঁড়িয়ে সুজাতা ভুরু কুঁচকে ভেবেছিলেন, আর ভেবেছিলেন
186 ব্রতী যদি সুজাতার দাদার মত দুরারোগ্য অসুখে মারা যেত, তাহলেও মৃত্যুর পর প্রশ্ন থাকতে পারত মনেসে প্রশ্নগুলো এইরকম হতডাক্তারের কোন ত্রুটি হল, না বাড়ির লোকের? ডাক্তারকে না ডেকে ডাক্তারকে ডাকলে কি হত? ওষুধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দিলে কি হত? ব্যাধিজনিত1 মৃত্যুর পরবর্তী প্রশ্নগুলো এই রকমই হয়ে থাকে
187 ব্রতী যদি দুর্ঘটনায় মরত তাহলে আগে প্রশ্ন হত, যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল, তা ব্রতী সাবধান হলে, এড়ানো যেত কিনা! তারপর প্রশ্ন হত, যে পরিস্থিতিতে
188
189 ১৯
190 দুর্ঘটনা ঘটল, তা কোন ভাবে এড়ানো যেত কিনা! সুজাতার যদি দিব্যনাথের মত কোষ্ঠীতে বিশ্বাস থাকত তবে প্রশ্ন হত কোষ্ঠীতে দুর্ঘটনাজনিত1 মৃত্যুর কোন ইঙ্গিত ছিল কিনা! ইঙ্গিত থাকলে তা প্রতিরোধের কোন নিদান ছিল কিনা!
191 ব্রতী যদি দণ্ডনীয় কোন দুরপরাধ1 করতে গিয়ে নিহত হত, তাহলে প্রশ্ন হত বাড়ির ছেলে হয়ে কার দোষে, কোন সঙ্গে পড়ে ব্রতী অপরাধী হল! কোন কোন প্রতিষেধক ব্যবস্থা করলে ব্রতীর এই পরিণতি এড়ানো যেত!
192 ব্রতী এর কোন কোঠাতেই পড়ে নাঅপরাধের মধ্যে ব্রতী এই সমাজে, এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস হারিয়েছিলব্রতীর মনে হয়েছিল যে পথ ধরে সমাজ রাষ্ট্র চলেছে সে পথে মুক্তি আসবে নাঅপরাধের মধ্যে ব্রতী শুধু স্লোগান লেখেনি, স্লোগানে বিশ্বাসও করেছিলব্রতীর মুখাগ্নি পর্যন্ত দিব্যনাথ জ্যোতি করেন নিব্রতী এমনই সমাজবিরোধী যে ব্রতীদের লাশ কাঁটাপুকুরে পড়ে থাকেরাত হলে পুলিশী হেফাজতে গাদাই হয়ে শ্মশানে আসেতারপর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়
193 রাতে লাশ জ্বলেযারা শ্রাদ্ধশান্তিতে বিশ্বাসী, তারাও শাস্ত্রের নিয়মে সকালে শ্রাদ্ধ করতে পারে নাতাদের বসে থাকতে হয় লাল, স্ফীত চোখে সারাদিনতারপর রাতে একটা ঘেটোবামুনের1 দোর ধরতে হয়
194 বামুনটা মাথা পিছু থোক টাকা নিয়ে রাতেভিতে1 শ্রাদ্ধ সেরে দেয় ঝটপট
195 ব্রতী স্লোগান লিখেছিলপুলিশ যখন ওর ঘর তল্লাশ করে তখন সুজাতা দেখেছিলেন স্লোগানের বয়ান সবব্রতীর হাতে লেখা
196 কেননা জেলই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়
197 বন্দুকের নল থেকেই....
198 এই দশক মুক্তির দশকে পরিণত হতে চলেছে....
199 ঘৃণা করুন! চিহ্নিত করুন! চূর্ণ করুন মধ্যপন্থীকে
200 আজ ইয়েনানে পরিণত হতে চলেছে
201 শুনেছিলেন ব্রতীরা বয়ান লেখে, তারপর দেওয়ালে লেখেরাতেভিতে
202
203 ২০
204 অন্ধকারে লেখেআবার কালুর মত মরিয়া হলে বেলা এগারোটায়, পুলিশ পাহারায় যখন পাড়া ঘেরাও, রাস্তায় যখন তপনের রক্ত শুকোয় নি, তখনই লালরঙের1 পোঁচড়া টেনে সম্ভ্রান্ত কোন বাড়ির পরিষ্কার দেওয়ালে লেখা, লাল বাংলার লাল কমরেড লাল তপনের লালরক্তে...বাজার পুড়িয়ে মা...
205 লিখতে লিখতে কালুও গুলি খায় বলে শেষ শব্দটা শেষ হয় নাওই রকমই থেকে যায়
206 ব্রতীরা এই এক নতুন জাতের ছেলেস্লোগান লিখলে বুলেট ছুটে আসে জেনেও ব্রতীরা স্লোগান লেখেকাঁটাপুকুর যাবার জন্যে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেয়
207 সুজাতা ব্রতীকে কোন রকম অপরাধীর কোঠাতে ফেলতে পারেন নি?
208 ব্রতীর জন্যে, কাঁদতে কাঁদতেই জ্যোতি দিব্যনাথ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, সমাজ বড় বড় হত্যাকারী, যারা খাবারে-ওষুধ, শিশু-খাদ্যে ভেজাল মেলায় তারা বেঁচে থাকতে পারে সমাজে নেতারা গ্রামের জনগণকে পুলিশের গুলির মুখে ঠেলে দিয়ে বাড়ি গাড়ি পুলিশ পাহারায় নিরাপদ আশ্রয়ে বেঁচে থাকতে পারেকিন্তু ব্রতী তাদের চেয়ে বড় অপরাধীকেননা সে এই মুনাফাখোর ব্যবসায়ী স্বার্থান্ধ নেতাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলএই বিশ্বাসহীনতা যে বালক, কিশোর বা যুবকের মনে ঢুকে যায়, তার বয়স বারষোলবাইশ যাই হক, তার শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যু
209 তার এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যুযারা মেরুদণ্ডহীন, সুবিধাবাদীহাওয়া বদল বুঝে মত বদলানো শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর সমাজকে বর্জন করে
210 তাদের শাস্তি মৃত্যুসবাই তাদের হত্যা করতে পারেসব দল মতের লোকেদের এই দলছাড়া তরুণের হত্যা করার নির্বাধ গণতান্ত্রিক অধিকার আছেআইন, অনুমতি, বিচার লাগে না
211 একা অথবা যূথবদ্ধভাবে1 এই বিশ্বাসহীন তরুণদের হত্যা করা চলেবুলেট-ছুরি-দা-বর্শা-সড়কি যে কোন অস্ত্রে যে কোন সময়ে শহরের যে কোন অঞ্চলে, যে কোন দর্শক বা দর্শকদের সামনে
212
213 ২১
214 জ্যোতি আর দিব্যনাথ এসব কথা সুজাতাকে পাখিপড়া করে বোঝানকিন্তু সুজাতা মাথা নেড়েছিলেন
215 না
216 ব্রতীর মৃত্যুর আগের প্রশ্ন হল কেন ব্রতী বিশ্বাসহীনতার ব্রতকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিল?
217 ওর মৃত্যুর পরের প্রশ্ন হল ব্রতী চ্যাটার্জীর ফাইল বন্ধ হল বটে কিন্তু ওকে হত্যা করে কি সেই বিশ্বাসহীনতার প্রজ্বলন্ত বিশ্বাসকে শেষ করে দেওয়া গেল? ব্রতী নেই, ব্রতীরা নেইতাতেই কি শেষ হয়ে গেল সব?
218 প্রশ্ন হল ব্রতীর মৃত্যু কি নিরর্থক? ওর মৃত্যুর মানে কি তবে একটা বিরাটনা’?
219 সব কী অলীক ছিল? অনস্তিত্ব? ওর বিশ্বাস? ওর ভয়হীনতা? ওর দুর্বার আবেগ? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সমু, বিজিত, পার্থ আর লালটুকে সাবধান করবার জন্যেই ষোলই জানুআরি নীল শার্ট পরে সুজাতাকে ছেলে ভুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়া? যাবার আগে হঠাৎ সুজাতার দিকে তাকানো? দেখে নেওয়া? সুজাতার সুন্দর অভিজাত, প্রৌঢ় মুখের প্রতিটি বেদনার রেখা দেখে মনে এঁকে নেওয়া?
220 সুজাতা মাথা নেড়েছিলেনঘর বন্ধ করে বেরিয়ে এসেছিলেনচাবিটা সেদিন থেকে ওঁর কাছেই থাকেওঁর ব্যাগেআর দুবছর ধরে রাতে উঠে আসেন সুজাতা! ব্রতীর ঘর ঝাঁট দেন, ধুলো ঝাড়েনবিছানা আবার পেতেছেন সুজাতাজুতো রেখেছেন আলনার নীচেজামাকাপড় গুছিয়েছেনতাঁর মত হাজার ছেলের মা সকলকে লুকিয়ে ছেলের জামায় হাত বোলায়, ছেলের ছবিতে আঙুল বোলায়?
221 ব্রতীর ঘরে বসে থাকেন সুজাতামনে মনে ব্রতীর সঙ্গে কথা বলেনচোখ বুজে ভাবেন ব্রতী কাছে আছেভাবেন কত মা কত ছেলেকে এমনি করে লুকিয়ে কাছে ডাকে, কাছে পেতে চায়?
222 ব্রতীর সঙ্গে কথা বলেন সুজাতাকখনো ব্রতী উত্তর দেয়, কখনো দেয় না
223
224 ২২
225 জ্যোতির ঘরে টেলিফোন বাজছেওটা ধরতে গিয়েই এত কথা মনে পড়ল সুজাতার
226 সমু আর লালটু, বিজিত আর পার্থর বাড়িতে টেলিফোন নেইটেলিফোন বাজিয়ে ওদের বাড়ির লোকের ঘুম ভাঙাবে নাআজ সমু, বিজিত আর পার্থের মা কি ভাবছেন? আজ সকালে?
227 বিনি শ্লথ পায়ে নাইলনের নাইটি পরে দরজা খুলে দিলওর চোখে মুখে বিরক্তিএত তাড়াতাড়ি বিনি ঘুম থেকে উঠতে চায় নাওর ঘুম ভাঙে না
228 নিয়মিত ঘুম আর বিশ্রাম জ্যোতি আর বিনির খুবই দরকারঅত্যন্ত প্রেমাসক্ত সুজাতার বড়ছেলে আর বউসুমনের আটমাস বয়স থেকেই অবশ্য ওদের খাট বিছানা আলাদা, তবু ওরা অত্যন্ত প্রেমাসক্ত দম্পতি বলে নাম আছেরক্তমাংসের সুখকে সুজাতা খুব দামী বলে জানতেনবিনিরা রক্তমাংসের সুখকে প্রেম থেকে ব্যবচ্ছিন্ন করে রেখেছে
229 ওদের প্রেম অন্যরকমওদের বিবাহবার্ষিকীতে খুব উদ্দাম পার্টি হয়একসঙ্গে ঘোরে দুজনে, বেড়াতে যায়সুজাতা শুনেছেন বিনি ক্লাবে গেলে জ্যোতি ছাড়া কারো সঙ্গে নাচে নাফলে সমাজে বিনির খুব সুনামসুজাতা ফোন তুললেন,
230 কে?
231 আমি নন্দিনী
232 নন্দিনী!
233 হ্যাঁ, আমি ফিরে এসেছি
234 কবে?
235 পরশু
236
237 আপনার সঙ্গে আমার একবার দেখা হওয়া দরকারআপনার ওখানে আমি যাব নাআপনি কি ব্যাঙ্কে যাবেন আজ?
238 আজ আমি যাব না নন্দিনীআজ আমার ছোটমেয়ে তুলির এনগেজমেন্ট
239
240 ২৩
241 তাহলে?
242 তুমি বল কোথায় গেলে দেখা হবেঠিক সন্ধ্যাটা বাদ দিয়ে আমি অন্যসময় যেতে পারি
243 চারটের সময়?
244 যেতে পারিকোথায় যাব বল?
245 একটা ঠিকানা দিচ্ছিআপনার বাড়ি থেকে বেশি দূর হবে না
246 বল
247 নন্দিনী ঠিকানা বললসুজাতা ফোন নামিয়ে রাখলেননন্দিনী! ব্রতী নন্দিনীকে ভালবাসতকিন্তু নন্দিনীকে কখনো দেখেন নি সুজাতা
248 জ্যোতির দিকে তাকালেনঘুমোলে, একমাত্র ঘুমোলেই জ্যোতির মুখে সুজাতা ব্রতীর মুখের আদল দেখতে পান
249 বেরিয়ে এলেন বারান্দায়বারান্দায় বেরোতেই বেশ শীতশীত করল! নন্দিনী আর ব্রতী কি একটা কবিতার কাগজ বের করেছিল? ওরা একসঙ্গে নাটক করেছিল, সুজাতার জলবসন্ত হয়, তাই যাওয়া হয় নিবাড়ি থেকে আর কেউই যায় নিশুধু হেম বলেছিল, ছোটোখোকা1 অনেক হাততালি পেয়েছে, জানলে গো মাসবাই খুব সুখ্যেত2 করেছে
250 হেমই গল্প করত ব্রতীর সঙ্গেসুজাতার কাছে যখন ব্রতী অচেনা হয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে ওর মুখ দেখে সুজাতা কথা বলতেও ভয় পেতেন, তখনো হেম বলতে পারত, রাজকাজজিতে1 যাচ্ছ তা জানি, এটুকু খেয়ে উদ্ধার করে যাও বাপু
251 সেই যে দীঘা যাচ্ছি, বলে ব্রতী দীঘার পথে বাস থেকে নেমে অন্য জায়গায় যায়, হেমই তখন ওর স্যুটকেস গোছগাছ করে দিয়েছিল
252 হেম বলেছিল ছোটখোকার সঙ্গে এট্টা1 মেয়ের ভাব আছে গো মা! ঠাকুর দেখে এয়েছে2ছোটখোকা বেরুলে3 মেয়েটা পথের ধারে দাঁইড়ে4 থাকেতা বাদে দুজনা একসঙ্গে চলে যায়মেয়েটা কালোপানা5
253
254 ২৪
255 সেই নন্দিনী! সুজাতার বুক ধড়ফড় করছে কেন? ব্যারালগান খেয়ে বেশি সময় শুয়ে থাকেন নি বলেনন্দিনী ফোন করেছে বলে?
256 বাথরুম থেকে সেজেগুজে বেরিয়ে এল বিনিঘাড় অবধি ছাঁটা রুক্ষ চুল নীল শাড়ীর ওপর নীল নাইলনের কার্ডিগানরঙে রং মিলিয়ে পরতে কখনো ভুল হয় না বিনিরদীপার হয় না, তুলিরও হয় নাবিনিকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে
257 কে ফোন করেছিল মা?
258 নন্দিনী
259 নন্দিনী!
260 ব্রতীর বন্ধু
261 বিনির মুখ কৌতুহলে ভরে গেল
262 নিচে যাচ্ছ কেন মা?
263 কি হবে না হবে দেখি! তুমি সুমনকে তোলওর ইস্কুল আছেবাস আসবে
264 নিচে তুলিই গেছে
265 সুজাতা হাসলেনআজ তুলির এনগেজমেন্টআজও বিশ্বাস করতে পারে না গিয়ে তদারক না করলেও বাড়িতে সকালের চা ব্রেকফাস্ট, দুপুরের রান্না, বিকেলের ঘর সাজানো সব হবে কাউকে বিশ্বাস করে না তুলি
266 ষোল বৎসর বয়সে ক্রাফ্ট শিখতে গেল তুলি লেখাপড়া ছেড়েইসেই সময় থেকেই সংসারের ভার নিলআসলে সি. . ফার্ম দাঁড়িয়ে যাবার পর দিব্যনাথ সুজাতাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিলেনসুজাতা শোনেন নিশাশুড়ি জীবিত ছিলেন ব্রতীর আটবছর অবধিততদিন পর্যন্ত সুজাতার একখানা কাপড় নিজের শখে কিনবার অধিকার ছিল না
267 সেই জন্য</