2 |
Maxim Gorky-র Mother-এর প্রতিচ্ছবি by রীনা সেনগুপ্ত |
3 |
|
4 |
= মা = |
5 |
|
6 |
প্রত্যেক ভোরে কারখানার তীব্র, তীক্ষ্ণ শব্দে, এই শিশির ভেজা ভোরে ওদের ঘুম ভেঙ্গে যায় আর ওদের ছোট ছোট ধূলিধূসরিত কুটিরগুলো থেকে বের হয়ে ওরা বাধ্য শ্রমিকের মতো এগিয়ে যায় ঐ কারখানার দিকে। ওদের মুখগুলি গম্ভীর, শরীরটাও যথেষ্ট ঘুম না হওয়ার ফলে শিথিল হয়ে আছে এখনও। তাও ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে ওরা এগিয়ে যায় কারখানার পাথরের খাঁচার দিকে। ওদের পায়ের তলায় কাদামাখা পথ চলে গেছে ঐ কারখানার পানে। আধো ঘুম ভাঙা স্বরে ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলতে বলতে চলে, তাতে গালাগালিও আছে, মুখ খিস্তিও আছে। কারখানা থেকে শোনা যাচ্ছে নানা রকম মেশিনের শব্দ, আর তার চিমনীগুলো থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বার হয়ে ছড়িয়ে পরছে পুরো গ্রামের ওপরে যেখানে শ্রমিকদের বসতি। |
7 |
|
8 |
আবার সন্ধ্যাবেলা, যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার লালচে আভা ওদের বাড়ীর ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে, কারখানা এই শ্রমিকদেরকে গলগল করে বার করে দেয়। আবার ওরা সেই পথ ধরে ঘরে ফিরে আসে। কালো মুখ, সারা গায়ে মেশিনের তেলের কটু গন্ধ নিয়ে। তাও ওরা খুশি মনে গল্প করতে করতে ওদের বাড়ীর দিকে এগোয়, প্রচণ্ড ক্ষিদে নিয়ে। সারাদিন কষ্টের পর একটু স্বস্তি, বাড়ী ফিরে খেতে পাবে, আর একটু শান্তি ও পাবে এই আশায়। |
9 |
|
10 |
একটা পুরো দিন কারখানাটা ওদের নিংড়ে, ছিবড়ে করে ছেড়ে দেয়। একটু শক্তিও থাকে না শরীরে, মনে হয় আর এক পা এগিয়ে গেলাম কবরের দিকে। তও বাড়ী ফিরে এসে একটু নিশ্চিন্ত লাগে যেন, ওদের দুর্গন্ধ, স্যাঁতসেঁতে বাড়ীই এখন ওকে শান্তি দেয় একটু। |
11 |
|
12 |
শুধু রবিবারে ওরা বেলা দশটা অবধি ঘুমোয়। তারপর বিবাহিত বা অবিবাহিত যেটুকু ভালো জামা জুতো পরে তৈরি হয়, চার্চে যাবার জন্যে। ছোটোরা দেরী করলে যথারীতি বকুনি খায় যাবার আগে। ওখানে ধর্ম কথা শোনার পর ফিরে এসে ওরা রাশিয়ান পেস্ট্রি খাবে, যাকে বলে পিরোগি1। এতদিনের অকথ্য পরিশ্রম এদের মুখের স্বাদ নষ্ট করে দিয়েছে একেবারে, শুধু আনন্দ পায় মদ্যপান। শরীরের এই অবস্থায় ওরা ভোদকার বোতল নিয়ে বসে আকন্ঠ পান করে বুঁদ হয়ে থাকে নেশার ঘোরে। 1Pierogi |
13 |
|
14 |
সন্ধ্যাবেলা ওরা অলসভাবে রাস্তায় ঘুরতে বার হয়। যাদের বুটজুতো আছে , হাতে ছাতা নেবে তা রোদ বা বৃষ্টি থাকুক বা না থাকুক। সবার অবশ্য জুতো বা ছাতা নেই। একটু সবাইকে দেখানো চাইতো। একজন আর একজনের সাথে দেখা হলে ওরা কারখানার আর মেশিনগুলোর কথাই বেশী বলে, যারা ওদের চৌপর দিন খাটিয়ে নেয়, সেই সব মালিকদের কথা বলে, অকথ্য গালাগালি করে বেশ করে। খুব কম সময় হঠাৎ কোনো নতুন কথা এসে যায়, বিদ্যুতের মতো একটুক্ষণের জন্য ব্যাস।তারপর বাড়ী ফিরে বৌদের সাথে তুমুল ঝগড়াঝাটি চলে, মারধোরও করে মদের ঝোঁকে বেশ।একটু কম বয়সিরা মদের দোকানে জমায়েত হয়ে, নাচ, গান, বাজনায় মেতে থাকে। মদের ঘোরে কোনোটাই সুন্দর হয় না খুব। |
15 |
|
16 |
ওদের ভেতরের এই অসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য খুব সামান্য কারনে প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া, মারামারি, হাতাহাতি চলে। কখনো খুবই রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় শেষ হয়। কোনো কোন সময়ে মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায় ব্যাপারটা।এটা ক্রমে বেড়েই চলেছে , মনের ক্ষোভ চেপে না রাখতে পেরে এরকম হতেই থাকে। এটা ওদের পূর্ব পুরুষ থেকেই হয়ে আসছে। একটা কালো ভয়াবহ ছায়ার মত এই ক্ষোভ ওদের কবরে যাওয়া পর্যন্ত তডা করে ফেরে। একটা অন্ধের মতো রাগ আর পাশবিকতা থেকেই যায়। |
17 |
|
18 |
ছুটির দিনে ওরা দেরী করেই বাড়ী ফেরে। নোংরা, ধূলিধূসরিত মুখ আর ছেঁড়া জামাকাপর পরা অবস্থায়। বক বক করছে, এমন ঝাড় দিয়েছি ব্যাটাকেযে বুঝেছে কত ধানে কত চাল। অথবা মার খেয়ে এসে কান্না করবে, তখন মদের কৃপায় তাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। কখনো কখনো বাবা মায়েরা ছেলে তুলে নিয়ে আসে কোনো নালা , নর্দমা পাশ থেকে মদে চূর অবস্থায়। ওরা গালাগালি দিয়ে , প্রচণ্ড মার লাগায়, তারপর ভেজা কাপড় ছাড়িয়ে বিছানায় পাঠায় , যাতে কাল সকালে কারখানার ভোঁ এর শব্দে উঠে কাজে যেতে পারে ঠিক। |
19 |
|
20 |
যদিও গালাগালি আর মারধোর রোজকার ব্যাপার, তবু ওরা জানে এটাই ঠিক হচ্ছে। যখন ওরা ছোট ছিলো ওদের বাপ ও এমনি করে ওদের বাপের হাতে মার খেয়েছে। জীবনটাই যে এই রকম, এই ভাবে একঘেয়ে বয়ে চলে। বছরের পর বছর, কতকগুলো নিয়ম আর অভ্যাসের জোরে দিনরাত কাটে। অথচ কারোই মনে হয় না যে এর কোনো প্রততিবিধান হোক। |
21 |
|
22 |
অনেক কাল পর পর কোনো আগন্তুক ওদের গ্রামে আসে। প্রথম প্রথম নতুন লোক বলেই সবাই উৎসাহ দেখায়। তারপর সে হয়তো গল্প করে, ও যেখানে কাজ করে এসেছে তার কথা বলে।কিছুদিন পরই ওদের উৎসাহ উবে যায়। তহলে সব জায়গায় যদি শ্রমিকদের একই দূ্র্দশা হয় তাহলে আর এ নিয়ে কথা বলে লাভ কী হবে? |
23 |
|
24 |
মাঝে কোনো নতুন আগন্তুক কিছু নতুন কথা শোনায়। ওরা কোনো তর্ক করে না তার সাথে,অবাক হয়ে শোনে শুধু, মনের মধ্যে কী যেন নাড়া দেয় যা ওদের বোধ বুদ্ধির বাইরে। যেন একটা আশার আলো ছায়ার মতো মনের দোরে সারা জাগায়। তখন ওরা আরো মদ খেয়ে এই অজানা বোধকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। |
25 |
|
26 |
এই নতুন লোককে ওদের মোটেই পছন্দ হয় না, কারণ ও সবার চেয়ে আলাদা। ওদের ভয় হয় পাছে ওদের দৈনন্দিন জীবনে এ কোনো পরিবর্তন আনতে পারে, যেটা ওদের পক্ষে সুবিধের হবে না। খুব কষ্ট আর দুঃখের জীবনের যে ছন্দ তা হারিয়ে যাবে। নতুন কোনো পরিবর্তন ওদের বোঝা আরো বাড়াবে বৈ কমাবেনা। তাই ওরা এসব লোককে খুব সাবধানে এড়িয়ে চলে। তারপর যখন সেই আগন্তুক চলে যায়, ওদের জীবন আবার চলতে থাকে নিরবিচ্ছন্ন একঘেয়েমীর মধ্য দিয়ে। |
27 |
|
28 |
এভাবেই পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে দিয়ে একজন শ্রমিক মারা গেল। এই গ্রামেই বাস করতো মাইকেল ভ্লাসভ ছোট ছোট চোখে সবাইকে পর্যবেক্ষন করতো ভারী ভুঁরু কুঁচকে। সব সময় সবাইকে সন্দেহ করা, অবিশ্বাসী মনে করা, আর জঘন্য হাঁসি হাঁসে। ও হচ্ছে কারখানার সবচেয়ে সমর্থ শ্রমিক। কিন্তু ওপর ওয়ালাদের সাথে বনিবনা না থাকায় তেমন কিছু রোজগার করতে পারে না। গ্রামের সকলে ওকে এড়িয়ে চলতো, কারণ প্রায় সব ছুটির দিনে ও করো সাথে ঝগড়া করে, মারধোর করে তবে ছাড়ে। তাই সবাই ওকে ভয় করে চলে সর্বদা। |
29 |
|
30 |
ওরা শোধ তুলবার জন্য কখনো হয়তো দলবদ্ধ ভাবে ওকে আক্রমন করে দেখেছে, এ অবস্থায় ঐ ভ্লাসব হাতে একটা পাথরের চাঁই বা লাঠি কিম্বা লোহার রড নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে তৈরি। ওর দাড়ি চোখের নীচ থেকে বুক অবধি নেমেছে, হাতে পায়েও বুনো মানুষের মতো লোমে ভরা। যেভাবে লোকের দিকে তাকায় যেন ভেতর পর্যন্ত দেখে নেবে। ওকে সবার মনে হয়, যেন একটা পাশবিক শক্তি ভয় শূন্য, যখন মারবে তখন নির্দয় একেবারে, একবার আমায় মেরে দেখ দেখি ভাব। ওর দাড়ির মধ্য হলদেটে দাঁত ঝলসাচ্ছে। এগিয়ে আয় হতচ্ছাড়ারা। ভয়ে সবাই বিড়বিড় করতে করতে পেছিয়ে যেত। আয় সব ইতর বাঁদরের দল, ওর চোখ দুটো ধূর্ত প্যাচার মতো জ্বল জ্বল করছে। এবার বল কে কে মরতে চাস আমার হাতে। কেউই তা চায় না। |
31 |
|
32 |
ওর কথার লব্জই ছিলো ইতর অসভ্য বাঁদরের দল। কারখানায় যেমন, পুলিশের হাতে পরলেও তেমন, আবার বাড়ী ফিরে এসে বৌকে ও একই সম্ভাষণ ছিনো ওর। “দেখ ইতর মেয়ে, আমার জামাটা যে ছিঁড়ে গেছে তা চোখেই পরেনি তোমার।” ওর ছেলের বয়েস তখন চৌদ্দ বছর হবে। ও ছেলের চুল ধরে আচ্ছা করে পেটাবে ভেবেছিল প্যাভেলকে।প্যাভেল একটা ভারী হাতুড়ি হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়ালো, “আমায় ছোঁবে না তুমি।” |
33 |
|
34 |
“কী বললি?”, বাপ তেড়ে এলো ছেলের দিকে, ছেলে রোগা লম্বা একটা বার্চ গাছের মতো হয়েছে এখন। |
35 |
|
36 |
“যথেষ্ট সহ্য করেছি আর নয়”, কালো বড় বড় চোখ মেলে হাতুড়িটা হাওয়ায় দুলিয়ে ছেলে জবাব দিলো। |
37 |
|
38 |
বাপ ওবার নরম গলায় বলছে, “যা ছেড়ে দিলাম তোকে, অসভ্য ইতর ছেলে!” তা একটু পরে বৌকে বলছে, “এখন থেকে আমার কাছে টাকা চাইরেনা, প্যাভেলই টাকা দেবে তোমাকে।” |
39 |
|
40 |
আর তাই দিয়ে তুমি মদ গিলে বসে থকবে তাইতো, বৌও মুখের ওপর জবাব দিলো আজ। |
41 |
|
42 |
সেটা তোমার ভাবতে হবে না, ইতর কোথাকার। |
43 |
|
44 |
এরপর মৃত্যু পর্যন্ত তিন বছর সে ছেলের সাথে লাগতে যায়নি, সত্যি বলতে কথাই বলেনি।ভ্লাসভের একটা কুকুর ছিল। রোজ সে তার সাথে সাথে কারখানা পর্যন্ত যেতো, আবার সন্ধ্যাবেলা ওর ফিরে আসার অপেক্ষায় গেটের কাছে বসে থাকতো। ছুটির দিনে ভ্লাসভ মদের আড্ডায় গেলে, ঐ কুকুরও ওর পিছু পিছু যেতো। এইভাবে সারাদিন কাটিয়ে মদে চূর হয়ে যখন রাতের খাওয়া খেতে বসতো কুকুরটাকেও নিজের থেকে খাবার খাওয়াতো আদর করে। তারপর বৌ বাসনপত্র সরাতে দেরী সেগুলো ছঁড়ে ফেলে মুখ ধুয়ে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে কর্কশ গলায় গান ধরতো। তখন ওর হাঁমুখ খোলা, আর চোখও বন্ধ হয়ে গেছে যতক্ষণ শরীরের শিথিলতা একটু কমছে, বোতলেও মদ অবশিষ্ট নেই তখন ও ঐ বেন্চের ওপর বা টেবলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরতো আবার পরদিন কারখানার হুইশলের ওঠার জন্য। কুকুরটা পাশেই ঘুমতো রোজ। |
45 |
|
46 |
ওর মৃত্যু হলো মর্মান্তিক কষ্টে, টানা পাঁচ দিন অসহ্য যন্রনায় ছটফট করে বৌকে বলতো, আমায় একটু বিষ এনে দাও। দাঁতে দাঁত চিপে যন্ত্রণা সহ্য করছে, নীল হয়ে গেছে সমস্ত শরীর। ওর বৌ গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলো, তিনি বললেন ওর অপারেশনের দরকার। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চলো।ও তখন চেঁচাচ্ছে, অসভ্য ইতর সব, আমি আমার মতো মরবো, তোমাদের মতো শয়তানের কথায় চলবো নাকী ? |
47 |
|
48 |
ডাক্তার বিদায় নেবার পর বৌটি চোখের জলে কাকুতি মিনতি করছে, যাতে তাঁর কথা মতন অপারেশন করে নেয়। ওরে অসভ্য ইতর , আমি ভালো হয়ে উঠলে সেটা তোর পক্ষে মোটেই ভালো হবে না তা জানিসতো, ঘুসি পাকিয়ে ঐ অবস্থায় বৌকে ভয় দেখাচ্ছে ও। |
49 |
|
50 |
ভোরে যখন কারখানার হুইশিল সারাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে তখন ভ্লাসভ মারা গেল। ওকে সমাধীস্ত করতে গেল ওর বৌ, ছেলে,ওর কুকুরটা আর কিছু ভিখারী খুচরো মানুষ। ওর বৌ সামান্য চোখের জল ফেললো নিঃশব্দে, ছেলে একফোঁটাও কাঁদলে না। যারা কবর দিতে এসেছিলো তারা বলাবলি করছে ও মরতে চেয়েছিলো তাই খুশি হয়ে মরেছে। একটা পশুর জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে।ওকে কবর দেবার পর সবাই যখন চলে গেছে, তখনও কুকুরটা ওর কবরের কাছে বসে রইলো অনেকক্ষণ, তখনও ওর প্রভুর গন্ধ শুঁকছে কবরের ওপর থেকে। |
51 |
|
52 |
To be continued... |