2 |
|
3 |
শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ |
4 |
|
5 |
০০:৩৫ |
|
ভায়েরা আমার, |
6 |
০০:৩৮ |
|
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। |
7 |
০১:১২ |
|
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তারা আজ তার অধিকার চায়। |
8 |
০১:২৪ |
|
কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। |
9 |
০১:৫৫ |
|
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। |
10 |
০২:১৭ |
|
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হল। আপনারা জানেন, দোষ কি আমাদের? |
11 |
০৩:০৭ |
|
আজকে [তিনি] আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আপনারা জানেন আলাপ আলোচনা করেছি। আমি [পাক] শুধু বাংলার হয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। তিনি মেনে নিলেন। |
12 |
০৩:৪৩ |
|
আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসব। আমরা আলোচনা করব। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব। এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও1 সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। |
13 |
০৪:০৫ |
|
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন, বসি, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করি। |
14 |
০৪:২৪ |
|
তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তার পরেও যদি কেউ আসে তাকে ছন্নছাড়া করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হল। |
15 |
০৪:৫৪ |
|
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল, দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। |
16 |
০৫:১৮ |
|
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন1। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন2। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। |
17 |
৫:৪১ |
|
কী পেলাম আমরা? জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এদেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি, তখনই তাঁরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। |
18 |
০৬:১১ |
|
তাঁরা আমাদের ভাই। আমি বলেছি তাঁদের কাছে এ কথা, যে আপনারা কেন আপনার ভাইয়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে, যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে, তার থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য। |
19 |
০৬:২৫ |
|
তার পরে উনি বললেন যে আমার নামে বলেছেন আমি নাকি [বলে] স্বীকার করেছি, যে ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। |
20 |
০৬:৩৫ |
|
আমি ওনাকে একথা বলে দেবার চাই আমি তাঁকে তা বলি নাই। |
21 |
০৬:৩৯ |
|
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, ঢাকায় আসেন1, কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তার পরে আপনি ঠিক করুন। আমি এই কথা বলেছিলাম। |
22 |
০৭:০৭ |
|
আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের আরটিসি1, কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে, বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, এবং যে বক্তৃতা করে এসেম্বলি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন। 1RTC = round table conference |
23 |
০৭:৩৬ |
|
আমি পরিষ্কার মিটিঙে বলেছি, যে এবারের সংগ্রাম, আমার মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। |
24 |
০৭:৫০ |
|
ভায়েরা আমার, |
25 |
|
|
২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখেই বলে দিয়েছি, যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। |
26 |
০৮:০৬ |
|
এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন, মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে, এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসা, আমরা, এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। |
27 |
০৮:৫৯ |
|
জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই। ভায়েরা আমার, তোমাদের আমার ওপর বিশ্বাস আছে? |
28 |
০৯:০৯ |
|
আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। |
29 |
|
|
আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার1 চাই, যে আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাছারী, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। |
30 |
০৯:৩৬ |
|
গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনও কিছু চলবে না। |
31 |
১০:১০ |
|
২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে1 বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের ওপর হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। |
32 |
১০:৩৫ |
|
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার1 নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। |
33 |
১১:০২ |
|
তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে1 রাখতে পারবা2 না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। |
34 |
১১:২৬ |
|
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যাঁরা পারেন আমার রিলিফ কমিটিকে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছিয়ে দেবেন। |
35 |
১১:৫৭ |
|
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবে না। |
36 |
১২:১২ |
|
[মনে] মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী1 যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। 1non-Bengali |
37 |
১২:৩২ |
|
মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনও বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনও বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নেবার1 পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। |
38 |
১৩:২২ |
|
আমি অনুরোধ করছি, আপনারা আমাদের ভাই। আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন1 না। জীবনে আর কোনও দিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি, তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই-ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার এদেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না। |
39 |
১৩:৫২ |
|
দ্বিতীয় কথা, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা1, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। |
40 |
১৪:১৯ |
|
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। |
41 |
|